লাখ লাখ স্বপ্নবাজদের স্বপ্ন বিক্রি করে কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়া সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এতে কাদেরকে তিনি বিসিএস ক্যাডার বানিয়েছেন সব বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সব ক্যাডারের আছে তার হাত ধরে সাফল্য পাওয়া লোক।
মঙ্গলবার (৯ জুলাই) থেকে আবেদ আলীর হাত ধরে ক্যাডার হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে একটি সরকারি সংস্থা।
জানা গেছে, অনেক আগে থেকেই পিএসসির প্রশ্নফাঁস শুরু হলেও গত ২৪তম ব্যাচে এটি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এরপর ২৫তম ব্যাচে প্রশ্নফাঁস বিষয়টি ধরা পড়ে। সে সময় পিএসসির মেম্বার ছিলেন মাহফুজুর রহমান। বর্তমানে দুর্নীতির মামলায় তিনি ১৩ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত। সে সময় মাহফুজুর রহমানের ড্রাইভার ছিলেন সৈয়দ আবেদ আলী। আবেদের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ তৈরি করা হয়েছিল। গ্রুপটির কাজ ছিল কাস্টমার যোগাড় করা।
গ্রুপটি পরিচালনা করতেন মাহফুজুর রহমান। ঢাকার গুলশানের একটি এলাকা এবং নীলফামারির কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ‘ভিন্ন জগৎ’ নামক দুই স্থানে টাকা দেওয়া কাস্টমারদের নিয়ে যাওয়া হতো। পরীক্ষার একদিন আগে সেখানেই তাদেরকে প্রশ্ন সরবরাহ করা হতো, রিসোর্টগুলোতে পড়ার ব্যবস্থাও রাখা ছিল। মাহফুজের কাছে দলীয় নেতাদের তালিকাও আসতো। সেই তালিকার পরীক্ষার্থীদের দেওয়া টাকা থেকে নেতাদেরকেও ভাগ দিতেন তিনি। এভাবেই হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন মাহফুজ। স্বাস্থ্যের বহুল আলোচিত মিঠু ঠিকাদারও তার চক্রের সদস্য ছিলেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী জানিয়েছেন, তিনি শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের ডাসারে রয়েছে আবেদের ডুপ্লেক্স বাড়ি। ঢাকায় রয়েছে একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি।
আবেদ আলী স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন, মাহফুজুর রহমানের ফাঁস করা প্রশ্নের মাধ্যমে ঠিক কতজন ক্যাডার হয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। তবে সব ধরণের বিসিএস ক্যাডার বানিয়েছেন তিনি। তার হাত ধরে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরসহ চার দলীয় জোটের দলীয় নেতাকর্মীরা বেশি বিসিএস ক্যাডারে হয়েছেন। তবে দলের পরিচয় দিলেও টাকা দেওয়া লেগেছে সবার। শত শত কোটি টাকা একটি ব্যাচ থেকে কামিয়েছে তারা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা জানান, আবেদ আলী যদি এতো সম্পদের মালিক হন। তবে যেসব কর্মকর্তার গাড়ি চালিয়েছেন সেসব কর্মকর্তা কত হাজার কোটি টাকার মালিক, তা আর বোঝার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে সাবেক পিএসসি মেম্বার মাহফুজুর রহমান ছিলেন হাওয়া ভবনের লোক। তার জন্য সরকারি কর্ম কমিশনে ছিল আলাদা রুমের ব্যবস্থা। সেসময় পিএসসির চেয়ারম্যানসহ সকলে তাকে ভয় পেতেন। এখন সরকারি প্রায় সব পর্যায়ে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা বিরাজ করার নেপথ্যে রয়েছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডার হওয়া। তারা চাকরিতে প্রবেশ করেছে দুর্নীতির মাধ্যমে।
মঙ্গলবার আবেদ আলীর আরেক সহযোগী একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে ১০ কোটি টাকার চেকসহ গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। কোন কোন কর্মকর্তা এসব টাকার ভাগ পেতেন তা তার মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে।
এর আগে গত ৮ জুলাই রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে সৈয়দ আবেদ আলী ও তার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান ওরফে সিয়ামসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতদের ৭ জন বিসিএসের ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার পদের ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
জবানবন্দিতে তারা বলেছেন, চাকরিপ্রার্থীদের হাতে প্রশ্ন দেওয়া হতো না। পরীক্ষার আগের রাতে তাদেরকে নিরাপদ জায়গায় রাখা হতো। রাজধানীর পল্টনে একটি গোডাউনে চাকরিপ্রার্থীদের জড়ো করা হতো। সারা রাত প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করিয়ে সকালে পরীক্ষা দিতে পাঠানো হতো। রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার ৪৬ জন প্রার্থীকে তারা পল্টনের একটি গুদামে রেখে পড়িয়ে পরীক্ষা দেওয়ান। বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এই চক্রটি ২৪তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে শুরু করে সর্বশেষ ৪৫তম বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস করেছে তারা। পাশাপাশি পিএসসির অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নন ক্যাডার পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও তারা ফাঁস করেছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান মোহাম্মদ আলী বলেন, আস্তে আস্তে আমরা অনেকের বিষয়ে তথ্য পাচ্ছি। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সকলকে গ্রেপ্তার করা হবে।